শ্রীকান্ত পাত্র, সাংবাদিক, ঘাটাল: দূর্গাপুজো ব্যয়বহুল হওয়ায় একমাত্র বিত্তবান লোকরাই দূর্গাপুজোর আয়োজন করতেন। রাজা, মহারাজা, জমিদার, পত্তনিদারদের মতো বিত্তবান লোকেরাই নিজেদের বাড়িতে বেশ ধুম ধামের সঙ্গে দূর্গাপুজো করতেন। প্রতি বছর যাতে স্থায়ীভাবে দূর্গাপুজো করা যায় তার জন্য নিজেদের বাড়িতে স্থায়ী মণ্ডপ বানিয়েছিলেন। আজ সেই জমিদার বা জমিদারি নেই কিন্তু পুজো মণ্ডপগুলি আজও তার সাক্ষ্য বহণ করে চলেছে। ঘাটাল মহকুমার বিভিন্ন গ্রামে আজও সেই জমিদারদের উত্তরাধিকারিরা বাড়িতে সেই মণ্ডপে পুজোর আয়োজন করে থাকেন। ইতিহাস বলছে, ইংরাজী ১৫৮২ সালে বঙ্গদেশে দূর্গাপুজো প্রথম হয় তাহেরপুর গ্রামের কংসনারায়নের বাড়িতে। কংসনারায়ণ সেই সময় রাজা বলেই খ্যাত ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন বাংলার প্রথম দূর্গাপুজো নদীয়ার জমিদার ভবানন্দ মজুমদারের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় ১৬০৬ সালে। পুজো উপলক্ষ্যে এই সব বিত্তবান মানুষ দেদার অর্থ খরচ করতেন। প্রায় উৎসবের চেহারা নিত পুজো প্রাঙ্গনে। বেশির ভাগটা কিন্তু নিজেদের আভিজাত্য প্রকাশ করতে আর নিজেদের ওজন বোঝাতে মহা আড়ম্বরে পুজোর আয়োজন করতেন। এইভাবেই দূর্গাপুজো বছরের পর বছর চলে এসেছে। একটা ধারণাই তৈরী হয়ে যায় বিত্তবান মানুষ ছাড়া এই মহা পুজোর আয়োজন সম্ভব নয়। ছন্দ পতন ঘটল বিশ শতকের গোড়ার দিকে। এই সময় গঙ্গা তীরবর্তী বলরাম বসু ঘাট রোড অঞ্চলে কিছু যুবক ও ব্যবসায়ী মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন " ভবানীপুর সনাতন ধর্মৎসাহিনী সভা "। এই সভার সদস্যরা একত্রিত হয়ে ১৯১০ সালে আরম্ভ করলেন সম্মিলিত উদ্যোগে দূর্গাপুজো। আবার একটি মত বলছে, ইংরাজী ১৭৯০ সালে হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়া অঞ্চলে ১২ জন বন্ধু বা ইয়ার মিলে দূর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। ওই একই সময়ে কলকাতার সিমলা ও বাগবাজার এলাকায় এলাকার কিছু উৎসাহী যুবক সম্মিলিতভাবে দূর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গদেশের সর্বত্র। এই ভাবেই শুরু হয় বারোইয়ারী বা বারোয়ারী দূর্গাপুজো কিন্তু দূর্গাপুজোর এত খরচ কে যোগান দিতো? কিভাবেই বা জোগাড় হোত পুজোর খরচ ? বলা হয়েছে, ওই বারো ইয়ার বা বন্ধু চাঁদা তুলে পুজোর খরচ তুলতেন। কীভাবে বারোয়ারী দূর্গাপুজোর চাঁদা তুলতে পাড়ায় পাড়ায় যেতেন ওই যুবকরা তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গিয়েছেন মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ। ইংরাজী ১৮৬২ সালে প্রকাশিত তিনি তাঁর ' হুতোম প্যাঁচার নক্সা' বইতে ব্যঙ্গ রচনাত্মক লেখায় সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন।
দূর্গাপুজোর
মহা খরচ তুলতে যেমন
আজকের সর্বজনীন পুজোর উদ্যোক্তারা গাড়ি আটকে, ব্যবসায়ী,
চাকুরীজীবি, বা তথাকথিত পয়সায়ালাদের
কাছে রসিদ বই নিয়ে
বাড়িতে, অফিসে ঢু মারেন সেকালেও
উদ্যোক্তারা একই ভাবে বিত্তবান
মানে জমিদার বা পত্তনিদার, ধন্যাঢ্য
ব্যক্তিদের কাছে চাঁদা আদায়
করতেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় তাঁর
‘হুতোম পেঁচার নক্সা’ বইয়ের ‘কলিকাতার বারোইয়ারী - পূজা' অধ্যায়ে সেকালের বারোয়ারী পুজোর উদ্যোক্তাদের চাঁদা আদায়ের বিবরণ তুলে ধরেছেন। সেকালেও
পুজোয় চাঁদা আদায়ে জোর জুলুম চলত।
এমনকি ইংরেজ প্রশাসন থেকে জোর জুলুম
করে চাঁদা আদায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তারপরও
অভিযোগ পেয়ে সরজমিনে তদন্ত
করতে তৎকালীন ২৪ পরগনার জেলাশাসক
পেটন সাহেব মহিলা সেজে পালকিতে চেপে
অভিযান চালিয়েছিলেন। যথারীতি মস্তানরা পালকি আটকায়। পালকি থেকে নেমে পেটন
সাহেব কয়েকজনকে পাকড়াও করেন।। তৎকালীন সংবাদপত্রে শিরোনাম
হয়েছিল ‘শ্রীযুক্ত পেটন সাহেবের স্ত্রী
বেশ ধারণ’। ১৮৪০
সালের ঘটনা। ‘হুতোম পেঁচার নক্সা’ বইয়ের ‘কলিকাতার বারো ইয়ারী পুজো’
অধ্যায়ে
কালীপ্রসন্নবাবু জোরজুলুম করে চাঁদা আদায়ের
বেশ কয়েকটি নজির তুলে ধরেছেন।
প্রথমত, উদ্যোক্তারা
নিজেদের সারা বছরের আয়ের
একটি অংশ বারোইয়ারী খাতে
জমা করতেন। জমা পড়ত পুজোর
অধ্যক্ষ (আজকের সম্পাদক) এর কাছে। এ
ছাড়া পাড়ার বর্ধিষ্ণুদের কাছ থেকে আদায়ও
জমা পড়ত। কীভাবে পাড়ায়
চাঁদা আদায় হোত ? জমিদার
বা গণ্যমান্য বা প্রভাবশালীদের বাড়িতে
প্রবেশ করায় খুবই কড়াকড়ি
ছিল। বাড়ির মূল ফটকে লাঠিধারী
দ্বারোয়ান থাকত। তাঁদের টপকে একেবারে 'বাবু'
র কাছে যাওয়া এক
প্রকার অসাধ্য ছিল বারো ইয়ারদের।
তাই দ্বারোয়ানকে উটকোচ দিয়ে খুশি করে
তবেই বাবুর কাছে যাওয়ার ছাড়
মিলতো। বাবু যদি কৃপণ
হতেন তাহলে তাঁর কাছ থেকে
চাঁদা আদায় করতে নানা
কৌশল নিতে হোত বারো
ইয়ারীদের। একটি কাহিনীর উল্লেখ
করেছেন কালীপ্রসন্নবাবু। তিনি লিখেছেন, ‘একবার বারোইয়ারী পুজোর একদল শহরের সিঙ্গি
- বাবুদের বাড়ী গিয়ে উপস্থিত।
সিঙ্গিবাবু সে সময় অফিসে
বেরুছিলেন অধ্যক্ষরা চার পাঁচ জন
তাঁহাকে ঘিরে ধরে ' ধরেছি
ধরেছি' বলে চেঁচাতে লাগলেন।
রাস্তার লোক জমে গেল।
সিঙ্গিবাবু অবাক, ব্যাপারখানা কি? একজন অধ্যক্ষ
বললেন, মশায়! আমরা অমুক জায়গার
বারো ইয়ারি পুজোর। মা ভগবতী সিঙ্গির
উপর চড়ে কৈলাস থেকে
আসছিলেন। পথে সিঙ্গির পা
ভেঙে গেছে। সুতরাং তিনি আর আসতে
পারছেন না। সেই খানেই
রয়েছেন। আমাদের স্বপ্ন দিয়েছেন যে, আর কোন
সিঙ্গির জোগাড় কত্তে পার, তাহলেই আমি
যেতে পারি। কিন্তু মহাশয় আমরা এক মাস
ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি কোথাও
আর সিঙ্গির দেখা পেলাম না।
আজ আপনার দেখা পেয়েছি কোন
মতে ছেড়ে দেব না
- চলুন যাতে মা র
আসা হয়, তারই তদ্বির
করবেন। " সিঙ্গিবাবু তাঁদের কথায় সন্তুষ্ট হয়ে,
বারোইয়ারীদের চাঁদার বিলক্ষন দশ টাকা সাহায্য
করেন (বানান অপরিবর্তিত)। এই ধরনের
কৌশলের পাশাপাশি চাঁদা আদায়ে জোর জুলুমের পথও
নিতেন বারো ইয়ারীরা। তার
উদাহরণ আগেই দিয়েছি।
সেই
সময়ের সংবাদ পত্রেও বারো ইয়ারীদের চাঁদা আদায়ের খবর ছাপা হয়েছিল।
সেই সময়ের বিখ্যাত সংবাদপত্র 'সংবাদ ভাস্কর' থেকে জানা যায়
তখনকার দিনে চাঁদার জুলুম
কম ছিল না। ওই
পত্রিকার বর্ণনা অনুযায়ী, সেকালে চাঁদা আদায়ের পদ্ধতি বেশ কঠোর ছিল।
অনেক ক্ষেত্রে জোর করে বা
ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা
হোত। ‘দ্বিতীয় অষ্টমের পেয়াদা’ দিয়ে
বোঝানো হোত নীলকর সাহেবরা
যেভাবে নীল কর আদায়
করতে নির্মম অত্যাচার চালাত সেভাবে বেরো ইয়ারীরা চাঁদা আদায় করতে সাধারণ
মানুষের উপর জুলুম করত।
১৮২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সমাচার
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ও ১৮৭১ সালের
' এডুকেশন গেজেট' -এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে
জানা যায় কীভাবে জোর
জুলুম করে চাঁদা আদায়
করা হোত। অবশ্য গাড়ি
আটকে চাঁদা আদায় করা বেশি
দিনের নয়। সেটি অবশ্য
বর্তমানে রাজ্য সরকারের সৌজন্যে অনেকটাই কমেছে। তবে চাঁদা আদায়ের
রেওয়াজ এখনও বজায় রয়েছে।
এ তো গেল চাঁদা
আদায়। পুজো উপলক্ষে আজকের
মতো পুজোর দিনগুলিতে বিভিন্ন আমোদ মূলক অনুষ্ঠানের
আয়োজন করা হোত সেকালেও।
‘হুতোম পেঁচার নক্সা’- তে তার বিশদ
বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। এমনকি মণ্ডপ কীভাবে সাজানো হোত, কীভাবে ঝাড়
লণ্ঠণের আলোয় সেজে উঠত
তারও বিবরণ দেওয়া আছে। পুজোর প্রথম
দিন থেকেই সন্ধ্যায় আখড়া শুরু হোত।
ঢাক, কাঁসর তো বাজতোই। সঙ্গে
রাত্রিকালীন গ্রামীণ যাত্রা পালা, সঙ সেজে অভিনয়,
তরজা কবির লড়াই, পুতুল
নাচ, পালাগান,, খেউর,, খ্যামটা নাচ,পাঁচালি গান,
কীর্তন গান সবই হোত।
বর্তমান সময়ে যেমন পুজো
উপলক্ষে জলসা, অর্কেস্ট্রা, অপেরা যাত্রা, ডান্স ট্রুপ সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
একালের মতো সেকালেও বারো ইয়ারীদের মদ্য
পানের চল ছিল। এমনকি
বেহেড মাতাল হয়ে মাতলামির পরিচয়ও
পাওয়া যায়। অর্থাৎ বারোইয়ারী
পুজোর শুরু থেকে একই
ধারা বজায় রয়েছে আজও
একালে। বারোইয়ারী পুজোয় দুর্গা প্রতিমা কেমন হোত ? ওই
অধ্যায়েই উল্লেখ করা হয়েছে, কোনও
কোনও প্রতিমা ২০ হাত থেকে
৬০ হাত উঁচু হোত
দুর্গা প্রতিমা। শেষ বিসর্জনের দিনে
প্রত্যেক পুতুল কেটে কেটে বিসর্জন
করতে হয়েছিল। বিসর্জনের
শোভাযাত্রা কেমন হোত? সেটিরও
বর্ণনা দিয়েছেন হুতোম পেঁচায়। সেকালের দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের হুবুহু তুলে ধরা হোল।
"বারোইয়ারী পুজো শেষ হলে
প্রতিমাখানি আট দিন রাখা
হলো, তারপর বিসর্জন করবার আয়োজন হতে লাগলো। আমমোক্তার
কানাইধনবাবু পুলিশ হতে পাশ করে
আনলেন। চার দল ইংরাজী
বাজনা, সাজা তুরুক সোয়ার,
নিশেন, ধরা ফিরিঙ্গি, আশা
শোটা, ঘড়ি ও পঞ্চাশটা
ঢাক একত্র হোল। বাহাদুরি কাঠতোলা
চাকা একত্র করে, গাড়ির মতো
করে তাতেই প্রতিমা তোলা হোল। অধ্যক্ষরা
(পুজোর কর্মকর্তারা) প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে চললেন, দুপাশে সংয়েরা সার বেঁধে চললো।
চিৎপুরের বড় রাস্তা লোকেরন্যা
হয়ে উঠলো, রাঁড়েরা ছাদের ও বারান্দা উপর
থেকে রুপো বাঁধানো হুঁকোয়
তামাক খেতে খেতে তামাশা
দেখতে লাগলো, রাস্তার লোকেরা হাঁ করে চলতি
ও দাঁড়ানো প্রতিমে দেখতে লাগলেন। শেষে গঙ্গাতীরে নিয়ে
বিসর্জন করা হয়"।
মিলিয়ে দেখুন তো সেকালের বিসর্জনের
সঙ্গে একালের বিসর্জনের কোনও মিল আছে
কি না !