"The earth is beautiful but it has a disease called man".
------- Leo Tolstoy
"ধর্ম"(Religion) ও "রাজনীতি"(Politics) দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। আলাদা ধারণা। কিন্তু এই দুটি ধারণা যখন একসঙ্গে মিশে যায় বা মিশিয়ে দেওয়া হয় তা যে কী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে তা আমরা দেখেছি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় বহু প্রাচীন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়। একদল উগ্র ধর্মাবলম্বী মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের মদতে ও সহযোগিতায় অন্য একটি ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মস্থানকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ওইদিন। তার জেরে সারা দেশে কী তান্ডব চলেছিল, ভারতীয় সংস্কৃতিকে কীভাবে খুন করা হয়েছিল তা আপামর ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। ধর্ম আর রাজনীতি মিশিয়ে গুজরাটের গোধরা কান্ড কেমন হতে পারে তাও দেখেছি আমরা। সেই শুরু। আজও আমাদের দেশে ধর্ম আর রাজনীতি পরস্পর ফণা তুলে চলেছে। অথচ এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসকদের কব্জা থেকে মুক্তি পেতে অখণ্ড ভারতবর্ষকে কিন্তু কেটে দু’টুকরো করা হয়েছিল এই ধর্ম ও রাজনীতির রাসায়নিক বিক্রিয়ার জেরেই। এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে দেশের সংবিধান প্রনেতারা চেষ্টা করেছিলেন "ধর্ম" ও "রাজনীতি" কখনই যেন মিশে না যায়। কিন্তু তা হোল কি? ধর্ম যাতে রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে না পারে বা রাজনীতি যাতে ধর্মকে প্রভাবিত করতে না তার আন্দোলন শুরু হয়েছিল পাশ্চাত্য দেশে। মার্টিন লুথারের কথা মনে আছে? মধ্যযুগে রাষ্ট্র ও গির্জার মধ্যে সংঘাত বেঁধেছিল এই নিয়ে যে রাষ্ট্রের প্রজারা কার কথায় বা কার নির্দেশে পরিচালিত হবে। দুই প্রতিষ্ঠানের সংঘাতের জেরে প্রজাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। এই সংঘাত থেকে মুক্তি পেতে সেন্ট আওগাঁস্টাইন, প্যাদুয়ার মারসেলিও, মার্টিন লুথার ক্যালভিনর নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। আমাদের দেশেও দেখেছি মহাভারতের যুগে কীভাবে রাজা মহারাজারা ঋষি, পুরোহিতদের দ্বারা পরিচালিত হতেন। যাই হোক, এই সংঘাত থেকে বিশ্বের সমস্ত দেশ পুরোপুরি মুক্তি পেয়েছে এ দাবি করছি না। তবে অনেক দেশ মুক্তি পেয়েছে, আবার অনেক দেশ আধা মুক্তি পেয়েছে এটা বলা যায়। ইউরোপে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম নেতা মার্টিন লুথার(১৪৮৩-১৫৪৬)বলেছেন, “শাসনকাজ পরিচালনার জন্য ঈশ্বর পুর প্রশাসক পাঠিয়েছেন, রাজা বা পুর প্রশাসক ছাড়া সমাজ অচল হয়ে পড়ত, অতএব সরকারকে একটা ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান বলা যেতে পারে। ধর্ম জগতের শাসক হলেন পোপ আর রাজনীতি জগতের শাসক হলেন রাজা”। তিনি বলেছেন, “Goverment is a barrier to anarchy”. তাঁর পরিষ্কার বক্তব্য ছিল ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা। মাটিন লুথার বিশ্ব চিন্তার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট স্থান পেলেও তাঁর আদর্শ সব দেশে প্রতিফলিত হয়নি। আমাদের দেশ এই ভারতবর্ষে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা রাখতে চেয়েছিলেন সংবিধান রচয়িতারা। কিন্তু তা পারলেন কি? বহু ভাষাভাষী, বহু ধর্মাবলম্বী, বহু জাতপাতের দেশ এই ভারতভূমি। দেশকে অখণ্ড রাখতে হলে ধর্ম ও রাজনীতিকে যেমন মিশিয়ে ফেলা চলবে না, ঠিক একই ভাবে জাতপাতের মধ্যে সমন্বয় রেখে চলার জন্য পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন ভি.আর. আম্বেদকর, নেহেরুরা। তা কি মানছেন আজকের প্রশাসকরা ? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, যেভাবে দুই প্রধান ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায় বিষধর ফণা তুলতে শুরু করেছে ফের সেই ১৯৪৭ সালের দৃশ্য দেখতে হবে না তো? এই নিয়েই এই প্রবন্ধের অবতারণা।
আগেই বলা হয়েছে, ধর্মাচরণ একটি ব্যক্তিগত বিষয়। ভারতে যেহেতু বিভিন্ন ধর্মের মানুষের অবস্থান, তাই সেদিকে তাকিয়ে আমাদের Nation Builders রা ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়তে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ ভারত রাষ্ট্র কতৃপক্ষ কোনও একটি বিশেষ ধর্মকে মদত করবে না। কিন্তু চাওয়া আর বাস্তবে পালন করা তো মোটেই এক জিনিস নয়। সংবিধানে ধর্মাচরণের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে ভবিষৎ-এর একটা বীজ পুঁতে দিয়ে গেলেন Nation Builders রা। আমরা একটু দেখে নিই সংবিধানে ঠিক কী বলা হয়েছে। অবশ্য সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে ধর্ম নিরপেক্ষ (Secular) রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ অ-ধার্মিক বা ধর্ম বিরোধিতা নয়। এর অর্থ হলো রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনও ধর্ম থাকবে না। সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ নম্বর ধারায় প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী ভারতের যে কোনও নাগরিক নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবেন। নিজস্ব ধর্মীয় সংগঠন, প্রচার, এমনকি নিজ নিজ ধর্মের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে সম্পত্তি ক্রয় বিক্রয় করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এই অধিকার বলেই বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন ধর্ম বিস্তারের চেষ্টায় সচেষ্ট। এমনকি ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ত প্রচারে জোর দেন প্রচারকরা। তবে ১৯৫০ সালে যখন সংবিধান চালু হয় তখন অবশ্য প্রস্তাবনায় এই আদর্শের কথা ছিল না। ১৯৭৬ সালে ৪২ তম সংবিধান সংশোধনের সময় Secular শব্দটি যুক্ত করা হয়। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা একমত হয়েছেন যে, ধর্ম নিয়ে নাক গলাবে না একটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসাবে সরকার। এমনকি কোনো রাজনৈতিক দলই ধর্ম মিশিয়ে রাজনীতি করবে না। সবচেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ভেঙ্কাটারমান। তিনি বলেছেন, " The state is neither religious nor irreligious nor anti religious but it is wholly detached from religious dogmas and activities and thus neutral in religious mattees. " সরকারে থেকে বা স্বীকৃত রাজনৈতিক দল হিসাবে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি বা রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল মানছে কি এই ব্যাখ্যা? বিখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ কাশ্যপ বলেছেন, সংবিধান প্রনেতারা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত বৈচিত্রকে ছাড়িয়ে যাবে এমন একটি উৎকৃষ্ট জাতির কথা ভেবেছিলেন। তাঁরা ধর্মের প্রতি বিতশ্রদ্ধ ছিলেন না, কিন্তু আশা করতেন রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা হবে এবং ধর্মীয় মতপার্থক্য জাতি গড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হবে না। তাঁরা সতর্ক ছিলেন, যে ধর্মীয় বিভাজনের জেরে দেশ ভাগ হয়েছে সেই পরিস্থিতি যেন আর তৈরী না হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই Nation Builders দের স্বপ্ন আশা আকাঙ্খা ও সতর্কবাণী বেমালুম ভুলে গেছেন আজকের শাসকদল। আজকের শাসকদল Secular শব্দটির অর্থ বা মর্মবস্তু উপলব্ধি করেন কি না বা করতে চান কি না তা নিয়ে আমার মতো অনেকেরই সন্দেহ আছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মাচরণ আর রাষ্ট্রীয় নেতা হিসাবে ধর্মাচরণের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা রাজনৈতিক নেতারা খেয়াল রাখেন না। তাঁদের আচার আচরণ অনেক সময়ই ধর্মনিরপেক্ষ থাকে না। সরকারি অনুষ্ঠানে ধর্মীয় রীতিনীতির ব্যবহার, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ভারত রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্রকেই ক্ষুন্ন করে বৈকি। প্রশ্ন তো জাগেই একজন রাজনৈতিক নেতা নেত্রী কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বা প্রতিষ্ঠানে গেলে ওই ধর্মের সাজ পোশাক পরেন কেন? এক কথায় স্রেফ রাজনৈতিক উদেশ্য ছাড়া আর কী হতে পারে? আর এই ধর্ম মিশ্রিত রাজনীতি কী ভয়ঙ্কর পরিণীতি ডেকে আনতে পারে সেই প্রসঙ্গে আসছি এবার।
সবার আগে মনে রাখতে হবে ভারতের সমাজ ব্যবস্থা ধর্মাশ্রিত। এখানে মানুষের জনজীবনে ধর্মের প্রভাব মারাত্মক রকমের। ফলে মানুষের মন বা মানসিক গঠনে সামন্ততান্ত্রিক প্রবনতা এখনও প্রবল। অতি দরিদ্র মানুষটিও নিজের পেটের ভাত কাপড়ের জোগাড়ের চেয়ে ধর্মের দিকে তাকিয়ে থাকে বেশি। আর ধর্মের প্রতি এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসন করতে সক্ষম হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটেছিলো এই ধর্মকে ভিত্তি করে ভারত বিভাজনের মাধ্যমে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এই প্রবনতা রয়ে গিয়েছে। আজ তা প্রবল আকার ধারণ করে চলেছে। ধর্মের প্রতি ভারতবাসীর এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে বর্তমানে কেন্দ্রের শাসকদল ও আমাদের রাজ্যের শাসকদল অত্যন্ত নিম্ন মেধার রাজনীতি করে চলেছে। রাজনীতিতে ধর্মের মিশেল দেওয়ার পরিণতি আমরা দেখেছি ভারত ভাগের মধ্যে দিয়ে। এর ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছি পাঞ্জাবের খালিস্তানি আন্দোলন ও তার পরিণতি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকান্ড ও তার পরবর্তী শিখ দাঙ্গা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাটের গোধরা কান্ড আরও কত কি! এরপরও শিক্ষা হয়নি রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের। অবশ্য এই ধর্মাশ্রিত রাজনীতির সূচনা হয়েছিল ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে দেশের নানা প্রান্তে গজিয়ে উঠেছিল বিভিন্ন সাম্রাদায়িক সংগঠন। আর্য সমাজ থেকে শুরু করে থিওশফিকেল সোসাইটি, ন্যাশনাল মহামেডান এসোসিয়েশন, হিন্দু ধর্ম ব্যবস্থাপক মন্ডলী আরও হরেক রকমের ধর্ম প্রভাবিত সংগঠন। মনে করুন, মহারাষ্ট্রের কেশরী উৎসব শুরু করে কী ধরণের প্রচার করতেন বাল গঙ্গাধর তিলক। তিনি বলতেন, আমরা সবাই হিন্দু ধর্মের পূজারী। আর শ্রী অরবিন্দ বলতেন, এই হিন্দু জাতির জন্ম হয়েছে সনাতন ধর্মের মধ্যে। অন্যদিকে খিলাফৎ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুসলিম জাগরণের কথা প্রচার হতে থাকে ওই সময়।"হিন্দু জাগরণ" ও "মুসলিম জাগরণ" এর মতো দুটি শব্দ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশ জুড়ে। অর্থাৎ তখনই দেশের মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে দুভাগ হয়ে যায়। এটা ঠিকই দুই প্রধান ধর্মের মানুষ ভাগ হয়ে গেলেও ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল একসঙ্গে। এই ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রভাবে ১৯২৩ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে ৭২ টি দাঙ্গা বেঁধেছিল সারা দেশে। আসলে সেই খোলস ছেড়ে আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলির নেতা নেত্রীরা। ঘটনা মোড় নিতে শুরু করে ষাটের দশক থেকে। স্বাধীনতা আন্দোলনের আবেগ, সাম্প্রদায়িক সংঘাতের স্মৃতি তখন ক্রমশ মলিন হতে শুরু করেছে। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে হিন্দু প্রভাবিত জনসংঘ ১৪ টি আসন দখল করে। সেই শুরু। আজ সেই দল ক্ষমতায়। বিজেপি যেভাবে হিন্দু ও হিন্দুত্বর প্রচার করে ভোট প্রার্থনা করে এবং ক্ষমতা দখল করে চলেছে তা নিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের হীন ভাবতেই পারে। আর এ থেকে অদূর ভবিষৎ এ মুসলিমরা আলাদা ভুখন্ড দাবি করবে না তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে ? রবীন্দ্রনাথ কবে সতর্ক করে লিখেছেন, “যে দেশ প্রধানত ধর্মের মিলনেই মানুষকে মিলায়, অন্য কোনও বাঁধনে মানুষকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশে ধর্মকে দিয়ে যে বিপদ সৃষ্টি করে সটাই সকলের চেয়ে সর্বণেশে বিপদ”। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে মানছে কে? না রাজনৈতিক দলগুলি না দেশের ধর্মান্ধ মানুষগুলি। কেন এখনও আমাদের দেশ ভারতবর্ষ পাশ্চাত্য দেশগুলির মতো হয়ে উঠলো না ? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক প্রভাত দত্ত তাঁর একটি লেখায় ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, যুক্তি ও বিজ্ঞানের ব্যাপক অগ্রগতি হয়নি এদেশে। যে রেনেসাঁর জোয়ারে ইউরোপে ধর্মান্ধতা ও কু - সংস্কার ভেসে গিয়েছিল সেই ধরণের ঘটনাও ঘটেনি এদেশে। সামন্তবাদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামি আজও গেড়ে বসে আছে মানুষের মনে। ধর্মীয় জেদাজেদির জেরে দেশ ভাগ হওয়ার পর ক্ষমতায় বসে কিন্তু সেই সামন্তবাদী মানসিকতার নেতারা। ভারতের শাসক শ্রেণীর এই শ্রেণী চরিত্র সেকুলার রাষ্ট্র গঠনের পরিপন্থী। তাই আজও ভারত রাষ্ট্র পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলির মতো শক্তিশালী হয়ে উঠে নি। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্র চালকরা আজও রাষ্ট্রের আইন কানুন পৌঁছে দিতে পারেনি বা চায়নি একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামে। এখনও গ্রামের মানুষ রাষ্ট্রীয় আইন কানুনের চেয়ে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সেই কারণেই আজও বাল্য বিবাহের মতো কু-প্রথা টিকে রয়েছে। তাই নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডাল (Guner Myrdal) বলেছেন "India is a soft state." কারণ ধর্ম ভারতবাসীর ধ্যানে, ধারণায়, কর্মে ও চেতনায়। এই সুযোগটাই নিচ্ছে চতুর রাজনৈতিক দলগুলি। অবশ্য এটা মানতেই হবে বামপন্থী দলগুলি প্রথম থেকেই রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা করে দেখতে চেয়েছে। বামপন্থী শাসিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রভাব ছিল না বললেই চলে। কিন্তু আজ? আমরা লক্ষ্য করছি দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিজেপি ও তৃণমূল কীভাবে ধর্মকে মিশিয়ে বা একটি সম্প্রদায়কে তোল্লা দিয়ে কী ধরনের রাজনীতি করে চলেছে। বিজেপি নেতারা তো সরাসরি হিন্দু ধর্মের প্রচার করে চলেছে। তার দোসর হয়ে উঠছে তৃণমূল কংগ্রেস। রামমন্দির, জগন্নাথ মন্দির নিয়ে কী মাতামাতিই না দেখলাম দুই রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির নেতা নেত্রীর মধ্যে। পিছিয়ে নেই জাতীয় কংগ্রেস নামক শতাব্দী প্রাচীন দলটি। এই দলটি সরাসরি ধর্মকে না মিশালেও সরাসরি বিরোধিতাও করেনি। রাজীব গান্ধীর মাচান বাবার কাহিনী তো সবার জানা। বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার সময় প্রধানমন্ত্রী নরর্সিমা রাওর ভূমিকা তো ইতিহাস। ধর্মাশ্রিত রাজনীতির কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ থাকা সত্বেও দুই রাজনৈতিক দল বিজেপি ও তৃণমূল ধর্মকেই আঁকড়ে রাজনীতি করে চলেছে। আর ধর্ম ভীরু ও ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন ভারতবাসীর একটি বৃহৎ অংশ তাঁদের ফাঁদে পা দিয়ে বসে আছেন। ফলে যা হওয়ার তাই হতে শুরু করেছে দেশে। ধর্মীয় দ্বন্দ্বের জেরে একটা সুন্দর দেশ, এই সুন্দর পৃথিবীকে এই মানুষই ধ্বংস করতে যথেষ্ট। সাধে কি পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক ও লেখক লিও তোলষ্টয়(Leo Tolstoy ) বলে গিয়েছেন, “The earth is beautiful but it has a disease called man."