শ্রীকান্ত পাত্র, সাংবাদিক, ঘাটাল: আরজি কর কাণ্ড নিয়ে তোলপাড় গোটা রাজ্যে। এমনকি সারা দেশে এবং বিদেশে র বহু জায়গায় এই ঘটনা সাড়া ফেলেছে। রাস্তায় নেমেছে সাধারণ মানুষ থেকে সব পেশার মানুষজন। কবি, লেখক, শিল্পী, ছাত্র, যুব, শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, নার্স , সংবাদকর্মী , সরকারি কর্মচারী , সাধারণ গৃহবধূ, এমনকি সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ জনও রাস্তায় নেমে ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন। কোনও রাজনৈতিক রঙ ছিল না। এই প্রতিবাদের রেশ এখনও চলছে। কবে থামবে জানা নেই। হতে পারে প্রতিবাদের ঢেউ আরও তীব্র হতে পারে বা থেমেও যেতে পারে। কী হতে পারে তা এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। এটা গোটা রাজ্যের চিত্র। এবার আসল প্রশ্নটা আমার ঘাটাল মহকুমা নিয়ে । যেহেতু ঘাটাল মহকুমা জুড়ে আমার কর্মক্ষেত্র তাই আমি এই গণজাগরণের প্রভাব ঘাটাল মহকুমায় কতটা পড়ল তা নিয়েই আমার পর্যবেক্ষণ। ঘটনার পরই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হতেই স্তম্ভিত গোটা রাজ্যের মানুষ। ধীরে ধীরে তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে দেশে বিদেশেও। ঘাটাল মহকুমাও বাদ যায় নি। গত ১৪ আগস্ট " মহিলারা রাত দখল করো " স্লোগানে মুখরিত হয় গোটা রাজ্যের মানুষ। ওইদিন রাতে ঘাটাল মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় মহিলা পুরুষ তাঁদের পেশাগত কর্মজীবন লুকিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। আমিও অসুস্থ শরীর নিয়ে তাঁদের সঙ্গে পা মিলিয়েছি। আমি গর্বিত। এছাড়া আলাদা আলাদা করে বিভিন্ন পেশার মানুষও তাঁদের মতো করে প্রতিবাদ করেছেন। রাস্তায় নেমেছেন। কিন্তু যাদের সবার আগে নামা দরকার ছিল তাঁরা কিন্তু চুপ ছিল। ঘাটাল মহাকুমার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন কবি লেখক শিল্পী সাহিত্যিক ছড়াকার গল্পকার। লিটিল ম্যাগাজিন গুলো দেখলে বোঝা যায় ঘাটাল মহকুমা জুড়ে গিজগিজ করছে এইসব প্রাণীকুল। রয়েছে গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ-র মতো একটি সংগঠন। এইসব প্রাণীকুলকে আম জনতা " বুদ্ধিজীবী" বলে মানেন। চিন্তায় ভাবনায় মননে এরা এগিয়ে থাকেন বলে দাবি করা হয়। আবার ঘাটালে সাহিত্য একাডেমী নামে একটি সংগঠনও রয়েছে। তাঁদের কেউ আলাদা করে ঘটনার প্রতিবাদ করে রাস্তায় নেমেছে বলে খবর নেই। এদেরকে কঠিনভাবে চুপ থাকতে দেখেছি সিংহডাঙ্গার মোড়ে বিদ্যাসাগর তোরণ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময়ও। অবশ্যই কোনও ঘটনার সমর্থন বা না সমর্থনের আধিকার রয়েছে সবার। তাই হয়তো কেউ কেউ সাধারণের মাঝে ভিড়ে রাস্তায় নেমেছেন। কেউ বা ঘরে বসেই দূরদর্শনের পর্দায় দেখে হু হা করেছেন। তো করতেই পারেন। সেটা তাঁর অধিকারের মধ্যেই পড়ে। প্রশ্নটা হল মঞ্চ সাজিয়ে দিলে হাত পা ছড়িয়ে বঙ্কিমী ভাষায় যে মধুর বচন ঝড়িয়ে দেন তাই নিয়েই। মঞ্চে উঠে গলা ফাটানো আর রাস্তায় নেমে গলা ফাটানো তফাৎটা বেশ বুঝতে পারি। তাঁদের কে দেখে আমার মনে হয় ওরা কবি লেখক শিল্পী সাহিত্যিক সেজে আসেন হয়ে আসেন না । তাই হয়তো আর জি কর কাণ্ডের মতো কোনও নৃশংস ঘটনার সমর্থন না করতে পারেন,চুপ থাকতে পারেন বা রাস্তায়ও নামতে পারেন। সেটা তাঁর অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তবে বুদ্ধিজীবী শব্দ নিয়ে কিন্তু ধোঁয়াশা থাকছেই। কাউকে বুদ্ধিজীবী র তকমা দিলে খুশিই হন । লিটিল ম্যাগাজিন বা কোনও পত্রিকায় দু একটি কবিতা বা গল্প বা কোনও লেখা প্রকাশিত হলে নিজেকে সার্থক মনে করেন। একটু বুদ্ধিজীবী সুলভ ভাবও দেখাতে শুরু করেন। একজন কবি বা লেখক বা গল্পকার, অধ্যাপক চিকিৎসক শিক্ষক কে কি বুদ্ধিজীবি বা বিদ্বোৎসমাজের লোক বলবো ? কিসের মাপকাঠিতে তাঁদের বিদ্বোৎসমাজের সদস্য বলবো বা বুদ্ধিজীবী বলবো? বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক বিনয় কুমার ঘোষ সমাজবিজ্ঞানী রবার্তো মিচেলস কে উদ্ধৃতি করে বলেছেন, প্রকৃত বিদ্বজন তাঁরাই, যাঁরা বিচার বিশ্লেষনে, চিন্তাশীলতা ও মননশীলতার পরিচয় দেন বেশি এবং সাধারণ ব্যক্তির তুলনায় প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়গোচর জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল কম । যাঁরা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় " মগজের ' সাহায্যে চিন্তা ও মনন করে জ্ঞান বৃদ্ধি করেন , তাঁরাই বিদ্বজ্জন। এই বিদ্বজ্জন মানুষরাই সমাজ কে পথ দেখায় । তাঁদের কথা সমাজের মানুষের কাছে পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়। সমাজে কোনও ঘটনা ঘটলে বা সমাজের আগাম ক্ষতির সম্ভাবনা বুঝতে পারলে এঁরা চুপ থাকেন না । প্রতবাদ করে উঠবেনই। মনুষ্য সমাজের সৃষ্টিকাল থেকে এর পরিচয় মিলেছে। এই প্রতিবাদের জন্য কম হয়রানির শিকার হতে হয় নি এদের। শাসকদলের রোসে পড়ে কত যে বিদ্বজ্জন প্রাণ হারিয়েছেন তার শেষ নেই । গুম খুন কী হয় নি ! ইতিহাসে তার প্রমাণ ভুরি ভুরি। বিপ্লবে আন্দোলনে এরাই থাকেন সামনের সারিতে। কিন্তু এটাও ঠিক কাজে কর্মে বিদ্বজ্জন বলে স্বীকৃতি পাওয়া মানুষজন কে শাসকদলের মোসাহেবী করতেও দেখা গিয়েছে যুগে যুগে। ঠিক এই কারণেই বার্ট্রান্ড রাসেল মন্তব্য করেছেন, সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী অর্থ বা জাগতিক সুবিধা থেকে দূরে থাকেন । কোনও বিশেষ দলভুক্ত হলে তিনি কখনও সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী হতে পারেন না । আমাদের অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, যাঁরা শিল্প সৃষ্টির জন্য জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন তাঁরা তাঁদের দেশকালের আর দশ জনের মতো আর দশটা সমস্যা নিয়ে ভাববেন কি না বা লিখবেন কি না মুখ ফুটে বলবেন কি না, কন্ঠস্বর উচ্চে তুলবেন কি না এই প্রশ্ন আমার সাহিত্যিক জীবনে প্রথম দিন থেকেই অনুসরণ করে এসেছে। আমাদের রাজ্যে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা গোটা সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। যার সর্বশেষ ঘটনা আর জি করের ধর্ষণ কান্ড। হাসপাতালে ঢুকে এক অন ডিউটি মহিলা চিকিৎসককে যেভাবে নৃশংস ভাবে ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে তার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। ওই মহিলা চিকিৎসক এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক সদস্য। যা কি না আমি আপনিও এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক সদস্য। একজন সহ নাগরিকের প্রতি সমবেদনা জানাতে এত দ্বিধা কেন ? পাড়ার কোনও ক্লাবের সদস্য বা প্রতিবেশী কেউ মারা গেলে আমরা তার পাশে দাঁড়াই। এক্ষেত্রেও তাই একজন সহ নাগরিকের প্রতি সমবেদনা জানাতে পারছেন না কেন ওইসব তথাকথিত চিন্তাশীল মানুষগুলো ? যাকে কি না নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে তার কর্মস্থলে। একটা তো বার্তা তো দেওয়া যায় আমরা এই ঘটনার প্রতিবাদী। ঘাটাল মহাকুমার ওই সব কবি লেখক শিল্পী সাহিত্যিক কে সংগঠিত ভাবে প্রতিবাদ করতে দেখলাম না । কেউ কেউ আলাদা একজন ব্যক্তি হিসাবে প্রতিবাদ করেছেন ঠিকই কিন্তু তাঁদের নিজস্বতা পরিচয়ে পথে নামতে দেখি নি। জ পল সত্রে (Sartre) দিয়েই শেষ করবো। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, A day comes when the pen is forced to stop,and the writer must then take up arms. .......writting is a certain way of wanting freedom,once you have begun,you are willy - nilly অর্থাৎ এমন দিন যদি লেখকের জীবনে আসে যখন লেখনী ছেড়ে অস্ত্র ধরা ছাড়া উপায় নেই। তখন তাকে তাই ই করতে হবে , তাঁর নিজের স্বাধীনতা , তাঁর পাঠক কুলের ও বৃহত্তর মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য।
আরও খবর পেতে নিচের লিঙ্কে টাচ করে আমাদের ফেসবুক পেজটি ফলো করুন ও ইউটিউব চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করুন 👇