বুদ্ধিজীবীরা এখন খাঁচার পাখি! নেই প্রতিবাদের ভাষা, বিকিয়েছে শিরদাঁড়া !

 কলমে: দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় (সমাজকর্মী): "বুদ্ধিজীবীদের আত্মমূল্যায়নের অহংকার তাঁদের জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।…আমি মনে করি ক্লাসিকাল বুদ্ধিজীবী এমন এক বুদ্ধিজীবী, যার অপসারণ প্রয়োজন।"—জঁ পল সার্ত্র (১৯৭৪ সালে হার্বাট মারকিউজ কে এক সাক্ষাতকারে)।সাধারণভাবে আমরা মনে করি বুদ্ধিজীবী হলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রবক্তা। সত্যান্বেষী। যুক্তি, তথ্য, প্রমাণ সহযোগে সত্যকে প্রকাশ করেন। তিনি সমবেত মানুষের কণ্ঠস্বর, ক্ষমতার দমনমূলক কার্যকলাপের বিরোধী। তিনি এক সর্বজনীন মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্বকারী। সকলের চেতনা, বিবেক ও প্রতিবাদের ভাষা। তিনি শক্ত শিরদাঁড়ার মানুষ। নির্ভীক। সত্য প্রকাশে সংকোচ, ভয় বা লজ্জাহীন। সমাজের প্রতি তিনি এতটাই দায়বদ্ধ যে নিজের মতামত কোনো রাজনৈতিক চালের কাছে কখনোই বিকিয়ে দেবেন না। শিবনারায়ণ রায় এর মতে বলা যায়:- "বুদ্ধিজীবীরা তথ্যের পেছনে তত্ত্ব খোঁজেন, ঘটনার পেছনে কারণিক পরম্পরা; বিচার-বিশ্লেষণ না করে তাঁরা কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেন না; তাঁদের মন নিয়ত প্রশ্নশীল; অনেকদিন ধরে চলে আসছে অথবা অনেক মানুষ সমর্থন করে বলেই কোনো অভ্যুদ্গমকে তাঁরা প্রমানিত সত্য বলে গ্রহণ করতে গররাজি; প্রতি প্রকল্পকেই তাঁরা যুক্তি এবং অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাই করতে অভ্যস্ত। জাড্য, যুথচারিতা এবং একাণ্বয়ের প্রকোপ থেকে সমাজ কে মুক্ত রাখা এঁদের প্রধান কাজ এবং এ কাজ এঁরা করতে পারেন যেহেতু এৃদের মনে জিজ্ঞাসা নিত্য সক্রিয়। " বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কথা উঠলেই আন্তনিও গ্রামশির প্রসঙ্গ আসবেই। তিনি বুদ্ধিজীবীদের দুটো গোষ্ঠীর কথা বলেছেন—১) প্রথাগত বুদ্ধিজীবী[ট্রাডিশনাল ইন্টেলেকচুয়াল] এবং ২) জৈবিক বুদ্ধিজীবী[অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল]। গ্রামশির মতে সমাজ বদলের ক্ষেত্রে যে গোষ্ঠী সরাসরি অবদান রাখেন এবং সামাজিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে সেই ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকেন- তাঁরাই হলেন অর্গানিক বুদ্ধিজীবী। এই বুদ্ধিজীবীরা শ্রমিক-কৃষকের আন্দোলনে সদর্থক ভূমিকায় অনেকসময়ই কর্মসূচিভিত্তিক অংশগ্রহণ করেন। অবশ্য তিনি এসব কথা বলেছিলেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা মাথায় রেখে। তিনি মনে করেন যে অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরা একটি পর্যায়ে ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবীদের পাশে থেকে একসঙ্গে ভাবনাচিন্তা করবেন এবং সংগঠিত হবেন। কারণ ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবীরা অর্থাৎ লেখক, দার্শনিক ও শিল্পীরা সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁদের বাদ দিয়ে বা তাঁদের সঙ্গে দুরত্ব বাড়িয়ে অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরা দূর্বল হয়ে যাবেন। তিনি এক্ষেত্রে একটি সার্বিক বা হোলিস্টিক বর্গের পক্ষে ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের প্রসার ও ক্ষমতা বৃদ্ধির সুবাদে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছিলো। সামাজিক কারণে হয়তো আমলারা(ব্যুরোক্র্যাট) শিক্ষা ও দক্ষতায় অনেকখানি এগিয়েছিলো। প্রশাসন ছিল এদের প্রায় একচেটিয়া ক্ষমতার ক্ষেত্র। কিন্তু সেই প্রশাসনের ক্ষমতা এখন রাজনৈতিক দল পুরোপুরি দখল করতে চাইছে। নীতি নির্ধারনের সাথে সাথে প্রশাসন যেন রাজনৈতিক দল ও তার কর্মীদের মৃগয়া ক্ষেত্র হয়ে উঠছে ক্রমশ। ফলতঃ, ব্যুরোক্র্যাট থেকে শুরু করে লেখক, নাট্যকার, শিল্পী, সাংবাদিক– প্রায় সবাই রাজনৈতিক দলের তাঁবেদারি করে তথাকথিত সম্মান ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাইছে। লুম্পেন জনসমাজও এই সুযোগে রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়েছে। এর ফলে হয়েছে মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়। সাথে আবার মাধুকরীবৃত্তি করে একদল কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষক ও শিল্পী নানারকম সুযোগসুবিধা ভোগ করতে শাসক দলের তাঁবেদারি করে চলেছে। উদ্দেশ্য হল যেন তেন প্রকারে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। আর এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে শাসকদলে ভিড়ে যাওয়া ছাড়া আজ অন্য কোন পথ তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের জন্য খোলা নেই। সরকারী রঙে বিবেক মেখে এই সমস্ত "বর্ণচোরা শিল্পী-বুদ্ধিজীবী" আজ একে একে অনেকেই সরকারের ঘনিষ্ঠ। তাঁরা হাওয়া মোরগ। হাওয়া যেদিকে, তাঁরাও সেদিকে। সরকার তথা শাসকদলের কাছে তাঁরা অনেকেই মেরুদণ্ড বন্ধক রেখেছেন। ঘাড়ে পাউডার দিয়ে, কাঁধে ঝোলা শান্তিনিকেতনি ব্যাগ নিয়ে বা কলারতোলা লাল, সবুজ বা গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে, পনিটেল বা ছাগলদাড়ি প্রদর্শিত করে, রাস্তার মোড়ে শনিঠাকুর প্রনাম করে, দশ আঙুলে দশ রকমের জ্যোতিষী আঙটি পরে, মাসিক অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন কমিটির সদস্য হয়ে, কামু-কাফকা-দেরিদা-কনস্ট্রাকশন-ডিকনস্ট্রাকশন-হেজিমনি শব্দবন্ধ ব্যবহার করে, কালো কফি, চারমিনার সেবন করে, জল্লাদ রাষ্ট্রের তাঁবেদারি করে গলায় পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণের মেডেল ঝুলিয়ে, ঘনঘন টিভিতে মুখ দেখিয়ে তাঁদের অনেকেই চিন্তক বা বুদ্ধিজীবী সেজেছেন। বুদ্ধিজীবী তাই আজ একটি খিস্তির নাম। কিন্তু আত্মস্বার্থ মুক্ত হয়ে বুদ্ধিজীবীদের ঝড়ের পাখি হয়ে উঠতে হয়, খাঁচার পাখি নয়। আসলে রবীন্দ্রজীবীদের মতো বুদ্ধিজীবীদেরও এই অন্তর্দ্বন্দ্বের অন্তর্তদন্ত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। তবে আশার কথা, দেশদ্রোহী, আর্বান নক্সাল বলে দেগে দেওয়া স্বত্তেও, ভারতে এখনও বহু নির্ভীক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যাঁরা চিন্তার চর্চার সাথে সাথে শাসকের ফ্যাসিবাদী চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে প্রশ্ন করার স্পর্ধা রাখেন, "রাজা, তোর কাপড় কোথায়?"


এলাকার খবর আমাদের সরাসরি জানাতে ফোন বা WhatsApp করুন 9647180572 নম্বরে। নিচের লিঙ্কে টাচ করে ঘাটাল রিপাবলিক টিভি ডিজিটাল মিডিয়ার WhatasApp গ্রূপে যোগ দিন 👇 

Join WhataApp Group

আরও খবর পেতে নিচের লিঙ্কে টাচ করে আমাদের ফেসবুক পেজটি ফলো করুন ও ইউটিউব চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করুন 👇

Follow our Facebook Page

Subscribe YouTube Channel



নবীনতর পূর্বতন