বন্যা ও রাজনীতি

কলমে: অধ্যাপক ড: শিবাজী বসু: বিস্তীর্ণ দু'পারের অসংখ্য মানুষের, হাহাকার শুনেও নি:শব্দে নীরবে,  গঙ্গা তুমি, গঙ্গা বইছ কেন’শ্রদ্ধেয় ভূপেন হাজারিকার এই গানটি বাংলা বা হিন্দিতে শোনেননি এমন ভারতবাসীর সংখ্যা খুবই কম। এই গান সবাই শুনেছি, তারিফ করেছি, তারপর অন্য কাজে মন দিয়েছি। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি এই গানটির কী তাৎপর্য? এই গঙ্গা নদী নিয়ে সরকারের কতই না মাথা ব্যাথা। গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান, গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশন, নমামি গঙ্গে, ন্যাশনাল গঙ্গা রিভার বেসিন অথরিটি প্রভৃতি পরিকল্পনা করেছে সরকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই গঙ্গা নিয়ে কতই না চিন্তা ভাবনা সরকারে। কিন্তু আজও গঙ্গার ভাঙন নিয়ে স্থায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। এই ধরুন পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে আজও নদী ভাঙন নিয়ে চিন্তিত স্থানীয় মানুষজন। কেন নদী ভাঙন রোধে আজও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হোল না ? এর উত্তর কে দেবে ? ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতি তো একটা রুটিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে কেন্দ্র রাজ্য সরকারের দড়ি টানাটানি বন্যা কবলিত মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। গোটা দেশের পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি না, আমাদের এই পোড়া বাংলার বন্যা রাজনীতি নিয়েই এবারের কলম ধরা।  এই বাংলায় কতই না নদ-নদী। এই নদ-নদী নিয়ে কবি সাহিত্যিকদের লেখালেখি তো কম হয় নি। নদ-নদীর রূপবৈচিত্র্য সব ঠাঁই পেয়েছে তাঁদের লেখায়। এমনকি নদী ভাঙনের জেরে বন্যা নিয়ে কত যে গান আর ছড়া কবিতা গল্প নভেল তৈরী হয়েছে তার হিসেব নেই। উত্তরবঙ্গের ভাওইয়া গান তো সর্বজনবিদিত।আমায় ভাসাইলি রে…, আমায় কাঁদায়ালি রে…..’। বা দক্ষিণবঙ্গের দামোদর ,কেলেঘাই , কাসাই,শিলাই ভাঙন আর বানভাসি মানুষের জীবন যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে পাতায় পাতায়। কিন্তু তাতে কী যায় আসে সরকারের? দেশ স্বাধীনতার এত বছর পরও বন্যা নিয়ে সরকারি কর্তাদের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। শাসকদল বিরোধী দলের চাপানউতর চলছেই। নদী ভাঙনের তার বন্যার কু-রাজনীতি সাধারণ মানুষকে আফিমের নেশার মতো বুঁদ করে রেখেছে আজও। বলা ভালো রাজনীতির কু-নাট্যে পড়ে তালগোল পাকিয়ে খাবি খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কেমন এই কু-নাট্যসদ্য স্বাধীন দেশকে পুণর্গঠনে যে ব্যক্তিটি আত্মনিয়োগ করেছিলেন তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। আর অঙ্গরাজ্যে হিসাবে পশ্চিমবঙ্গকে পুণর্গঠনে কোমর বেঁধেছিলেন রাজ্যের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়। কেন্দ্রে রাজ্যে একই দলের সরকার হওয়ায় যে কোনও উন্নয়নমূলক কাজে কোনও কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে অবশ্যই নদী ভাঙন রোধ বন্যা নিয়ন্ত্রণ দেশ রাজ্যবাসীর মনে আশা জুগিয়েছিল। কিন্তু এই দুই ব্যক্তির প্রয়াণের পর ধীরে ধীরে কেন্দ্র রাজ্যের রসায়ন বদলাতে থাকে। বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের উত্থান রাজনীতিতে উন্নয়নমূলক কাজে মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করে। যে কোনও উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ে শাসক বিরোধী দলের চাপানউতর বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দিতে শুরু করে আম জনতাকে। দেশ বা রাজ্য পুণর্গঠনের বদলে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিভিন্ন সামাজিক কাজের উপর জোর দিতে শুরু করলো শাসকদল। পিছনে পড়ে গেল নদী ভাঙনের মতো গুরুত্বপুর্ন দায়িত্ব নদী ভাঙন বন্যা প্রতিরোধের জন্য ডিভিসি- মতো বিভিন্ন নদী পরিকল্পনা যা হয়েছে সেই ষাটের দশকের শুরুতে। রাজ্যের প্রধান প্রধান যে সমস্ত নদ-নদী গঙ্গা , ভাগীরথী, দামোদর , মহানদী, তিস্তা, তোর্সা,মাটোলা রূপনারায়ণ ,শীলাবতী ,কংসাবতী সহ বিভিন্ন নদ নদী খননের কাজ নিয়ে শুরু হল কেন্দ্র রাজ্য সরকারের চাপানউতর। নদ-নদী, খাল-বিল মজতে মজতে প্রায় নালায় পরিণত হতে চলেছে নদী খালগুলির জল বহন ধারণ ক্ষমতা হারাতে বসেছে। ভারী বৃষ্টি হলেই বন্যা পরিস্থিতি জোরালো হয়ে উঠে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবী জুড়ে ঋতু বৈচিত্র্য ঘটেছে, আর অজানা নয়। তার জেরে একদিকে যেমন প্রচণ্ড খরা অন্যদিকে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে। নদী খালগুলি কয়েক দশক ধরে নিকাশি না হওয়ায় জল উপচে বন্যা কবলিত হয়ে পড়ছে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলি। এমনকি নদী খাল বাঁধ গুলি নজরদারির অভাবে বেদখল হয়ে হয়েছে বা এখনও হয়ে চলেছে বাঁধ দখল করে বাড়িঘর থেকে শুরু করে দোকান ব্যবসা এমনকি রাজনৈতিক দলের অফিস পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। সেচ দফতরের এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা আমার বন্ধু স্থানীয়। তিনি বলছিলেন শাসকদলের মদতেই নদী খাল বাঁধগুলি বেদখল হয়েছে কয়েক দশক ধরে। এতে প্রচণ্ড দুর্বল হয়েছে বাঁধগুলি। একে তো নিকাশীর কোনও উদ্যোগ নেইনি সরকার। তার ফলে মজে গিয়েছে সব কটি নদী খাল।  আগের থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়েছে। পাশাপাশি নাব্যতা হারিয়েছে নদী-গুলি তারই ফলশ্রুতি বন্যা আবার দেখুন , রাজ্য জুড়ে সমস্ত নয়নজুলি নিকাশি নালা ভরাট করে গড়ে উঠছে বহুতল বিশিষ্ট বাড়ি। কোনও হেলদোল আছে সরকারের ? ক্রমশ নিকাশি ব্যবস্থা স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর এর জেরেই যে বন্যা প্রবণতা বাড়ছে কথা জোর দিয়েই বলছেন আমার বন্ধুটি। অথচ এসবের দিকে নজর না দিয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পেতে চায় শাসকদল। কী রকম ? বন্যা হলেই কাড়ি কাড়ি ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বন্যা কবলিত মানুষের কাছে পৌছে যায় সরকার তথা শাসক দল। উদ্দেশ্য, এই ত্রাণ সামগ্রী দিয়েই বন্যা পিড়িত মানুষের যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিতে চায় তারা। বন্যার কারণ তথা বন্যা নিয়ন্ত্রণের দিকে কোনো উদ্যোগ নেয় না, আর এই ত্রান সামগ্রী বনিয়েই চলে সীমাহীন রাজনীতি। দক্ষিণবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে  শাসক বিরোধী রাজনীতি বেশ জোরালো হয়ে উঠছে। ঘাটালের বন্যা তো আর একদিনে তৈরি হয় নি। একের পর এক শাসকদল এসেছে গিয়েছে। দীর্ঘকাল বামেরা ক্ষমতায় ছিলো রাজ্যে। কেন হোল না ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান ? পালা বদলের পর এখন তো তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। কেন্দ্র সরকার টাকা দেয়নি বলে নিজেদের দায় যেমন সেরেছে বাম সরকার, একই ভাবে দেয়নি রাজনীতি করে চলেছে এই সরকারও। শেষমেষ রাজ্য সরকার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নামে এখন যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা নিয়ে তো সন্দেহের দানা বেঁধেছে জনমানসে।  শুধু তো ঘাটাল নয় বন্যা সমস্যা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে। কেন্দ্র সরকারের ঘাড়ে বা পূর্ববর্তী সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় সারছে বর্তমান রাজ্য সরকারও তার ফল ভুগছে সাধারণ মানুষ। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার কী পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রে বা রাজ্যেগত শতকের পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে বন্যা ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন অনুভূত হয় ১৯৫৪ সালে চালু হয় জাতীয় বন্যা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি। সেসময় প্রায় হাজার কিমি দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে প্রায় মিলিয়ন হেক্টর এলাকাকে বন্যার হাত থেকে সুরক্ষিত করা হয়। এরপর বোঝা গেল বন্যার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মোটেই সহজ নয়। তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার পাশাপাশি বন্যা কবলিত মানুষকে যথা সম্ভব সুরক্ষা কবচ দেওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়। ওই কর্মসূচি ঘোষণার পর পশ্চিমবঙ্গে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন গঠন করা হয়। এরপর একের পর এক দেশে নদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে কেন্দ্র সরকার। যদিও আজও ডিভিসি পরিকল্পণা সম্পূর্ণ হয় নি। মোট আটটি বাঁধের মধ্যে মাত্র চারটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও রাজনীতির অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে। তাই রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে সরব হয়েছিল রাজ্যের বাম সরকার। এমনকি বর্তমান রাজ্য সরকারও কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে সরব হয়েছে। জল সম্পদ বিশেষজ্ঞ এমএসমেনন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র এই নিয়ে আলোকপাত করেছেন। এম.এস.মেননযোজনা’ পত্রিকার জুলাই ২০১৬ সংখ্যায় লিখেছেন , অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্যার থেকে কিছুটা মাত্রায় সুরক্ষা প্রদান বাস্তবে অসম্ভব নয়। বন্যার হাত থেকে পুরোপুরি নিষ্কৃতি দিতে সক্ষম - এমন কোনও সর্বজনীন সমাধান নেই নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আরও বেশি বাঁধ জলাধার নির্মাণ করতে হবে। " রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সভাপতি নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রর মতে, নিম্ন দামোদর অববাহিকাকে সম্পূর্ণ বন্যা মুক্ত করা না গেলেও মানুষের দুর্দশা লাঘব করা সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর, রাজ্যে সেচ দফতর মিলে একটা আধুনিক বন্যা মোকাবিলা কর্মসূচি রূপায়ণ। " মানছে কি কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার ? বরাবরই দুই সরকার রাজনীতির দাবা খেলতে ব্যস্ত। বন্যা হয়ে উঠেছে রাজনীতির হাতিয়ার। আর বোকা মানুষ রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে আসল সত্যটা ধরতেই পারছেন না। বুঝতেই পারছেন না বন্যা আসলে কী? ভোট বৈতরণী পার না ধোঁকার টাটি ! আসলে গঙ্গা নদীর মতো নিঃশব্দে নীরবে নিভৃতে কেঁদে যেতে হবে অশিক্ষিত মূর্খ গরীব গুর্বো সাধারণ মানুষকে। আর ফায়দা লুটবে রাজনীতির কারবারীরা।



নবীনতর পূর্বতন