“বাল্যবিবাহ ও আজকের সমাজ” ✍️কলমে- অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড: শিবাজী বসু

"ধন বা নিজ দেহের উপর নারীর কোনও অধিকার নেই"     --মৈত্রেয়ী সংহিতা, তৈত্তিরিয় সংহিতা, শতপথ ব্রাহ্মণ, মনু সংহিতা।

প্রজনার্থং স্থিয় সৃষ্টাঅর্থাৎ প্রজননের জন্যই নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে

  --মনু সংহিতা। 

  পুত্রার্থা হি স্ত্রীয়অর্থাৎ পুত্র প্রজননের জন্য নারীর সৃষ্টি হয়েছে

   __কৌটিল্য।  

প্রাচীন ধর্ম শাস্ত্রে দানাত্মক বিবাহ পদ্ধতিতে কন্যাকে দান সামগ্রী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কন্যা দানের বস্তু। দানকর্তা পিতা। "তাসমধ্যা হু স্ত্রীয়ো ভোগোমেব হারয়তেঅর্থাৎ নারী একাধারে পুত্র সন্তানের জননী ভোগ্যবস্তু। আমি আর বেশি উদাহরণ দিতে চাই না। আজও এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে আমাদের সমাজে নারীকে পণ্য, দানসামগ্রী ও ভোগ্যবস্ত হিসাবে দেখা হয়। পুরোহিত ডেকে মন্ত্র উচ্চারণ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষজন একটি নারী ও পুরুষের বিবাহকার্য সম্পন্ন করেন। বিবাহের মন্ত্রের ছত্রে ছত্রে নারীকে পুরুষের অধীনস্থ ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, একটি কন্যা সন্তানের ঋতুমতী বা রজস্বলা হওয়ার আগেই বিবাহ দেওয়ার ধর্মীয় বিধির বিধান দেওয়া হয়েছে বেদ, উপনিষদ

থেকে শুরু করে মনু সংহিতা এমনকি কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্রে। এই ধর্মীয় বিধি মেনে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের বিবাহ দেওয়ার প্রথা চালু ছিল। এই বিধিতেই আমাদের দেশের বহু মনিষীদের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। অষ্টমবর্ষ বা নবমবর্ষের কন্যার বিবাহকে "গৌরীদন" প্রথা বলা হয়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী সহ বহু মনিষীদের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে ধর্মীয় প্রথা মেনেই। যদিও পরবর্তীকালে সবাই এই বিবাহের বিরোধিতা করেছেন। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন রামমোহন ও বিদ্যাসাগর। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাল্য বিবাহের বিরোধিতা করে কলম ধরেছেন। মহাত্মা গান্ধী বাল্য বিবাহকে নিষ্ঠুর প্রথা বলে উল্লেখ করেছেন। মহাত্মা গান্ধী তাঁর "আত্মকথা" বইতে লিখেছেন, “এরকম অদ্ভূত অল্পবয়সে বিবাহ দেবার আমি কোনও নৈতিক সমর্থন খুঁজে পাই নাতিনি আরও বলেছেন, “হিন্দু সমাজে যেমন বাল্য বিবাহের মতো নিষ্ঠুর প্রথা রয়েছে, এর দোষ ত্রুটি কাটানোর মতো রেওয়াজও আছেআমাদের দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শিক্ষাবিদ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ তাঁর ‘Religion and Society’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন রামায়ণ মহাভারত যুগে বাল্য বিবাহ প্রচলিত ছিল না। প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসক Susrot বলেছেন, “পুরুষের দৈহিক শক্তির পূর্ণ পরিণতি হয় ২৫ বছর বয়সে ও নারীর ১৬ বছর বয়সে। ওই বয়ঃপ্রাপ্তির আগে বিবাহ হলে তা হানিকর হতে পারেরাধাকৃষ্ণন ভাগবতের উদাহর তুলে বলেছেন, ৩০ বছরের পুরুষকে ১৬ বছর বয়সী বালিকাকে বিবাহ করতে বলা হয়েছে। নিজের বাল্য বিবাহ হওয়া সত্ত্বেও রাধাকৃষ্ণ তীব্রভাবে বাল্য বিবাহের বিরোধিতা করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্র বাল্য বিবাহের কুফল ব্যাখ্যা করে বিস্তর আলোচনা করেছে। দেশের সরকার নারী-পুরুষের বিবাহের বয়স নির্দিষ্ট করে আইন কার্যকর করেছে। বাল্য বিবাহের বিরোধিতা করে সরকারের প্রচারের খামতিও নেই। তাহলেও কেন আজও টিকে আছে বাল্য বিবাহ? একটি নারী ও পুরুষের যৌন মিলনের জন্য ধর্মীয় অনুশাসন এতটাই আমাদের সমাজে গেড়ে বসেছে যে আজও আমরা এই যুগে এর শেকড় উপড়ে ফেলতে পারি নি। তবে এটা ঠিক আগের তুলনায় আধুনিক শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাল্য বিবাহ সংখ্যা আনেকটাই কমেছে। এটা অবশ্য উচ্চবর্ণ, উচ্চশিক্ষিত এমনকি সচ্ছল পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। খুব কম ধীর গতিতে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাল্য বিবাহ সংখ্যা কমছে। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করতে সরকারি প্রচেষ্টার কোনও খামতি নেই। এটা মানতেই হবে। তাহলেও এই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে কেন নির্মূল হচ্ছে না বাল্য বিবাহ?  সরকারি প্রচেষ্টাই বা কী ? এই যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কি বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ?   পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একটি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে রাজ্যে যত প্রসব হয়েছে তার মধ্যে নাবালিকা প্রসূতি ছিল ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। আর ২০২৪-২৫ বছরে তা ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। শতাংশের হারে কমলেও বিষয়টি যে উদ্বেগের তা নিয়ে কোনও সন্দেহ

নেই। ওই রিপোর্টে জানা যাচ্ছে মাত্র ১৯ বছর বয়সে দ্বিতীয় সন্তানের মা হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। আর সেই সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। এই নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি মুর্শিদাবাদ, দুই ২৪ পরগনা, মালদহ, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায়। কমবেশি অন্য জেলাতেও নাবালিকা প্রসূতির তথ্য রয়েছে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে যেই ব্যাখ্যা দিন না কেন নাবালিকা বা বাল্য বিবাহ তো ঘটছে। বাল্য বিবাহ বন্ধে সরকারি নানা প্রকল্প কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে স্কুল পড়ুয়াদের। তারপরও নাবালিকা প্রসূতির ঘটনা ঘটছে কেন? এই নিয়ে রাজনৈতিক চাপান উতোর চলতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন একটাই বাল্য বিবাহ বন্ধ তো হচ্ছে না। অথচ আমরা সবাই চাই সমাজ থেকে বাল্য বিবাহ  নির্মূল হোক। সেই কবে ১৮৫০ সালে বিদ্যাসাগর মশাই "বাল্য বিবাহের দোষ" প্রবন্ধ লিখে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে গিয়েছেন। সেই প্রচার আজও থামে নি। সেই সময়ই বিদ্যাসাগর নানান যুক্তি বিশেষ করে হিন্দু শাস্ত্রের ব্যাখ্যা তুলে ধরে তিনি বলে গিয়েছেন, হিন্দু আইনে বিবাহ কোনও চুক্তি নয়, এটি একটি ধর্মীয় আচরণ, সংস্কার। বিদ্যাসাগরের প্রস্তাব ছিল নারীর প্রথম ঋতুর আগে পুরুষের পক্ষে বিবাহ করা একটি অপরাধ। যেহেতু অধিকাংশ মেয়েরই ১৩, ১৪ বা ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগে ওই লক্ষণ দেখা যায় না। উল্লেখ করা যায়, শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে ৯ বা ১০ বছর বয়প্রাপ্তির আগেই মেয়েদের বিবাহ দিয়ে দেওয়া হোত। বিদ্যাসাগরের আগে রাজা রামমোহন রায়ও বাল্য বিবাহের বিরোধিতা করেছেন। শাস্ত্র সম্মত বাল্য বিবাহের বিরোধিতা করে তৎকালীন সমাজপতিদের কোপে পড়েছিলেন এই দুই মনীষী। বিদ্যাসাগরের বাল্য বিবাহের বিরোধিতা ব্রিটিশ সরকার সমর্থন করেছিল। ভারতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ দণ্ডবিধি তৈরী হয় ১৮৬০ সালে।। আইনটি চালু হল ১৮৬২ সালে। এই আইনে বলা হোল, স্ত্রীর বয়স ১০ বছরের কম হলে তার সম্মতি হোল বা না হোল ওই স্ত্রী সংসার্গ বলাৎকার হিসাবে গন্য হবে। এই আইন একটি ঘটনার জেরে ১৮৯০ সালে সংশোধন করে ১০ বছরের বদলে স্ত্রীর বয়স ১২ করা হয়। বিদ্যাসাগরের যুক্তি ছিল বয়সটা বিষয় নয়, ঋতুমতী হওয়ার আগে স্বামী তার সঙ্গে সহবাস করতে পারবে না। এক্ষেত্রে তিনি হিন্দু শাস্ত্র তুলে ধরে বলেছিলেন, প্রথম রজঃদর্শনের আগে স্ত্রী সহবাস নিষিদ্ধ। এই প্রচারের জেরে আট ন বছরের মেয়ের গৌরীদান বিবাহ অনেকটাই বন্ধ হয়। বিদ্যাসাগর অনেক আগেই বলে গিয়েছেন, আইন করে কোনও কুপ্রথা নির্মূল করা যায় না। আইনটি তার পক্ষে অবশ্যই পূর্ব শর্ত মাত্র। এই যুক্তি আজও সঠিক বলে মনে করি। ভারতীয় সমাজে বাল্য বিবাহ দীর্ঘকাল ধরেই অভিশাপ হিসাবে গন্য করা হয়েছে। এর জন্য অশিক্ষা যেমন দায়ী তেমনই আমাদের আর্থ সামাজিক কারণও দায়ী। কন্যার বিবাহ দিতে একজন পিতাকে প্রায় সর্বশান্ত হয়ে যেতে হয়। এই পন প্রথাকে আগে নির্মূল করতে হবে। এখানেও সেই শাস্ত্র বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগেই তো বলা হয়েছে, কন্যা একটি দান সামগ্রীর মতো। বিবাহকালে বরকে কন্যা দানের সঙ্গে আরও অনেক সামগ্রী দান করার প্রথা আজও চল রয়েছে। দানের শাস্ত্রীয় পরিচয় হোল, স্ব স্বত্তেনিবৃত্ত পূর্বকং পর স্বত্বৎ পেদোনং দানম"কন্যা দানের ক্ষেত্রে যুক্ত দক্ষিনা থেকে বৈদিক পরবর্তী সমাজে বর পনের বীজ রোপিত হয়ে যায়। এই বর পনের বিষাক্ত ছোঁবল থেকে রেহাই পেতে অনেক বাবা মা অল্প বয়সে মেয়ের (নাবালিকা) বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগী হন। পণপ্রথা বন্ধে আইন থাকলেও ঘুর পথে আজও জেঁকে বসে আছে আমাদের সমাজে। মানুষের মনের মধ্যেই এই প্রথাগুলি গেঁথে দিয়ে গিয়েছেন হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রকাররা। বাল্য বিবাহ বন্ধে আইন কী বলছে ?  ব্রিটিশ  ভারতে প্রথম দণ্ডনীতি চালু হয় ১৮৬০ সালে। ওই আইনের ৩৭৫ ও ৩৭৬ ধারায় ধর্ষণ বিষয়ে যা উল্লেখ করা হয়েছিল তা হোল স্ত্রীর বয়স দশ বছরের কম হলে ধর্ষণ বা বলাৎকার বলে গন্য হবে। এই আইন অবশ্য দুবার ১৮৭০ ১৮৭২ সালে সংশোধন করা হয়েছিল। ফের ১৮৯০ সালে স্ত্রীর বয়স ১০ থেকে বাড়িয়ে ১২ করা হয়। কিন্তু কোনও নাবালিকা বিয়ে বন্ধের নির্দিষ্ট কোনও আইন তৈরী

হয় নি। বাল্য বিবাহ বন্ধে সমাজে এক শ্রেণীর সচেতন চিন্তাশীল মানুষ জোরালো আর্জি জানাতে থাকেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। তার ফলে ১৯২৯ সালে প্রথম বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ করণ আইন তৈরী হয়। বাল্য বিবাহ সংযমণ আইন  (The child Marriage Restraint Act -1928) এই আইনের আগে পাত্র পাত্রীর বিবাহের বয়স বাঁধা ছিল না। এবার পাত্রের বয়স ১৮ ও পাত্রীর বয়স ১৪ বেঁধে দেওয়া হোল। বাল্য বিবাহের অভিযোগ উঠলে পাত্র ও তার অভিভাবকের ১০০০ টাকা জরিমানা বা এক মাসের জেল বা দুইই হতে পারে এই আইনে। কিন্তু বিবাহ অসিদ্ধ হোত না। ফের আইন সংশোধন করা হলো ১৯৭৮ সালে। এবার বলা হোল পাত্রের বয়স ২১ ও পাত্রীর বয়স ১৮ বছর বিবাহের ক্ষেত্রে বৈধ। তার আগে বিবাহ নাবালিকা বিবাহ বলে গন্য করা হবে এবং আইনত দণ্ডনীয়। ভারত সরকার ২০০৬ সালে সর্বশেষ আইন জারি করে বলে দিয়েছে, নাবালিকা বিবাহ নির্মূল করতে কঠোরভাবে এই আইন প্রয়োগ করতে হবে। জেল বা জরিমানা বা দুটো শাস্তির নিদান দেওয়া হোল এই আইনে। ওই বিবাহ বাতিল বা অসিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হোল। এই আইনে সাজা হিসাবে দুবছরের জেল এক লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করা যেতে পারে ঘোষণা করা হয়েছে। বলে রাখি, এই বিধি বা আইন কেবল হিন্দুদের জন্য বলবৎ করা হয়। তার আগে ১৯৬১ সালে পন প্রথা নিষিদ্ধকরণ আইন পাশ হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে -হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই আইন বলবনয় কেন? মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে নাবালিকা বিবাহ বন্ধের কোনও রাষ্ট্রীয় আইন নেই। এখানে শরীয়ত আইন প্রযোজ্য। মুসলিম সমাজে বিয়ে হোল নরনারীর বৈধ মিলন ও শরীয়ত সম্মত এক বিশেষ চুক্তি। এই চুক্তিতে বলা হয়েছে, ১৫ বছর বয়স্ক যে কোনও মুসলিম ছেলে মেয়ে বিয়ের চুক্তি করতে পারে। বাবা মায়ের অনুমতি ছাড়াই এই বিয়ে চুক্তি করতেই পারে। একই দেশে একই নাগরিকদের ক্ষেত্রে বিবাহ বিধি নিয়ে আলাদা আইন কেন ? একটি ১৫ বছরের মুসলিম মেয়ে যদি বিয়ে করতে পারে একটি ১৫ বছরের হিন্দু মেয়ে কেন বিয়ে করতে পারবে না ? যৌন মিলনের জন্য কেন একটি হিন্দু মেয়েকে আরও চার বছর অপেক্ষা করতে হবে?  কেনই বা একটি ১৮ বছরের ছেলেকে যৌন মিলনের জন্য আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে? মুসলিম ও হিন্দু পুরুষ ও নারীদেহ কি আলাদা প্রকৃতির? চিকিৎসা বিজ্ঞান চিকিসকরা বাল্য বিবাহ সচেতনতা শিবিরে বারবার বলে থাকেন, মেয়েদের  শরীর ১৮ র আগে সন্তান ধারণ করলে বিভিন্ন কুফল দেখা দিতে পারে। তা কি কেবল হিন্দু নারী শরীরের ক্ষেত্রে? মুসলিম নারী শরীরের ক্ষেত্রে নয়? এই নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে। বাল্য বিবাহ বন্ধ কি শুধু হিন্দু মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? আমি আগেই উল্লেখ করেছি রাজ্য সরকারের প্রকাশ করা নাবালিকা প্রসূতির তথ্য। সেখানে অবশ্য বলা নেই কত হিন্দু নাবালিকা প্রসূতি বা কত মুসলিম নাবালিকা প্রসূতি। ইদানিং স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা ছেড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসার প্রবানতা বাড়ছে। এই কম বয়সী ছেলে মেয়েরা কেন এত তাড়াতাড়ি যৌন মিলনে কাতর হয়ে পড়ছে? সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বেলদা কলেজে এই নিয়ে একটা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সমীক্ষা করেছিল ওই কলেজের শিক্ষা বিজ্ঞান বিভাগ। ১৩২ জন কলেজ ছাত্রীর উপর সমীক্ষা করে যে তথ্য উঠে এসেছিলো তা চমকে দেওয়ার মতো। ৯৫ শতাংশ মেয়ে জানিয়েছেন তাঁরা জোর করে না পালিয়ে গেলে তাঁদের বাবা জোর করে ৫০ বছর বয়সী পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিত। এমনিতেই আমাদের সমাজে এখনও বহু পরিবারে মেয়ে ১৩ বছর বয়সে পা দিলেই বাবা মেয়েরা বিয়ের চিন্তা ভাবনা শুরু করে দেন। মেয়ের জন্য ভালো পাত্র খোঁজা থেকে শুরু করে টাকা পয়সা সঞ্চয় সবই করতে থাকেন বাবা মা। মেয়ে ১৬ বা ১৭ য় পা দিলেই বাবা মায়ের ঘুম উবে যায় অনেক পরিবারে। এখনও আমাদের সমাজে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার চেয়ে পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে আনন্দের বান বয়ে যায়। আসলে সেই বৈদিক পরবর্তী যুগ থেকে কন্যা সন্তানকে সংসারের পাপ হিসাবে দেখানো হয়েছে। হিন্দু শাস্ত্র বলছে,একটি নারী কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। আরও এক ধাপ এগিয়ে কোনও কোনও শাস্ত্রকার বলেছেন, পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্জা অর্থাৎ পুত্র সন্তান পাদনের জন্যই স্ত্রী। পুত্র সন্তান না হলে একজন নারীকে মেরে পিটে তাড়িয়ে দেওয়ার নিদান দিয়েছে শাস্ত্র। এই শাস্ত্রীয় বিধান আমাদের সমাজে আজও গেড়ে বসে রয়েছে। অনেক প্রান্তিক পরিবারে বা সমাজে ত্রয়দশ বর্ষিয়া কন্যা সন্তান বোঝা বিশেষ। তাঁদের বিয়ে দিতে পারলে যেন বেঁচে যান অভিভাবকরা। এখানে কোনো আইন কাজ করে না। শাস্ত্রীয় বিধান ই শেষ কথা তাঁদের। তাঁদের মাথা থেকে এই ধর্মের গোঁড়ামি উপড়ে ফেলতে না পারলে বাল্য বিবাহ বিরোধী আইন আইন হিসাবেই থেকে যাবে আইনের পাতায়। সেই বিদ্যাসাগরের কথা আবার বলি, শুধু আইন করে কোনও কু প্রথা নির্মূল করা যায় না। আইনটি কেবল পূর্ব শর্ত মাত্র। লেখক ড: শিবাজী বসুর কলমে এই বিশেষ প্রতিবেদনটি ভালো লাগলে শেয়ার করে অন্যদের কাছে পৌছে দিতে পারেন।



 

নবীনতর পূর্বতন