আজ ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক, শিক্ষাবিদ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন। ভারতের মানুষ তাঁকে একজন দার্শনিক শিক্ষাবিদ হিসাবেই মনে রেখেছেন। তিনি আমাদের দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ অলংকৃত করেছেন। তিনি ছিলেন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। আজ তাঁর একটি অজানা দিক তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক শ্রীকান্ত পাত্র। ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড: সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও মানবপ্রেমিক বলে পরিচিত। তিনি যে একজন খ্যাতনামা রাজনীতির লেখক তা নিয়ে চর্চা খুবই কম হয়েছে। কূটনীতি তথা রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও তিনি একজন সম্মানিত পুরুষ এবং লেখক হিসাবে বিশ্বের সুধী সমাজে বিশেষভাবে পরিচিত। ড: রাধাকৃষ্ণন ভারতে ও বহির্ভারতে ভারতত্বের একজন শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। আগাগোড়া স্বকীয় উদ্যম মেধা ও ব্যক্তিত্বর জোরে ভারতের সর্ব্বোচ শিখরে আসীন হতে পেরেছিলেন, সে তো আমরা সবাই জানি। পাশাপাশি রাষ্ট্রনীতি চর্চার ক্ষেত্রেও তিনি পরিচিতি মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন, উড্রো উইলসন ও ট্যামাস জেফার্শনের সঙ্গে একাসনে বসতে পারেন। তাঁর রাষ্ট্রনীতি চর্চা নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়েছে। রাধাকৃষ্ণনকে আমরা সাধারণত একজন অন্যতম বিশ্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক বলেই জানি। কিন্তু তিনি যে রাষ্ট্রনীতি ও সমাজনীতির ক্ষেত্রেও বিরাট অবদান রেখে গিয়েছেন তা আমরা অনেকেই অজ্ঞাত।। বিশেষত তাঁর লেখা ' Religion and Society ' বইটি পড়লে রাষ্ট্রনীতি ও সমাজনীতি নিয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা আমরা জানতে পারবো। বিশেষ করে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর মতামত খুবই মূল্যবান। রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থায় এখনও পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হিসাবে গণতন্ত্রের বিকল্প কোনও শাসন ব্যবস্থা উঠে আসেনি। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা নিয়ে মুখে অনেক কথা বললেও নির্বাচিত শাসকদল গণতন্ত্র মানেন না বলে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে। আসলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা মেনে চলতে হলে শাসককেই আগে গণতান্ত্রিক হতে হবে বলে জোরালো দাবি করেছেন রাধাকৃষ্ণন। "গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসি " নিয়ে তাঁর মতামত আলোচনা করাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। যা গুরুতের ক্ষেত্রে কোনোমতেই Abaraham Linkon বা Woodro Wilson বা Tomash Jefarson র চেয়ে কম নয়। তার আগে দেখে নিই গণতন্ত্র সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণা কী বা গণতন্ত্র (Democracy) নিয়ে তাবড় তাবড় লেখক বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কে কী বলে গিয়েছেন। প্রথমেই বলে রাখি গণতন্ত্রের কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই। তবে গণতন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন লেখক ও রাষ্ট্রনেতাদের বক্তব্য থেকে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। গণতন্ত্রের ইংরেজি ‘ডেমোক্রেসি’ কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে গণতন্ত্রের ধারণা। আবার ‘ডেমোক্রেসি’ শব্দটি এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ ‘ডেমোস’ বা জনগন ও KROTAS বা শাসন বা কতৃত্ব থেকে। প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সে গণতন্ত্র সম্পর্কে প্রথম পরীক্ষার সূত্রপাত হয়। গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যায় বহুজনের শাসন বা Multitude Rule র কথা উল্লেখ করেছেন। মধ্যযুগে ইংলন্ডে ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে মহাসনদ বা Magna Carta ও পরে ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে গৌরবময় বিপ্লব বা Glorious Revolution গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা প্রসারে সহায়তা করে। রাষ্ট্রনীতির বিখ্যাত তিন লেখক Hobbes, Locke ও Rousseau গণতন্ত্রের ধারণাকে আরও প্রসারিত করেন। তাঁদের মূল কথাই হলো জনগণের দ্বারা শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। মার্ক্সবাদীরা আবার একধাপ এগিয়ে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বা Socialist Democracy র কথা বলেছেন। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র নতুন রূপ লাভ করে। মার্ক্সবাদীদের মতে, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রই হোল পূর্ণ গণতন্ত্র। আবার গণতন্ত্রের অর্থ বলতে শুধু শাসনব্যবস্থা বা সরকার বোঝায় না। এটি এমন একটি সমাজব্যবস্থা যাতে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ পদ্ধতির সার্থক সমন্বয় হয়, বলেছেন বিখ্যাত লেখক আর এইচ টনি । গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হোল সাম্য। শাসন ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণই হলো গণতন্ত্রের মূল কথা। আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই বিখ্যাত উক্তি ' Government of the People, By the People and for the People ' মনে করিয়ে দেয় এক্ষেত্রে। বিখ্যাত লেখক J S Mill র সংক্ষিপ্ত কথা, Admission of all to share of the sovereign power of the state. আবার অনেকেই গণতন্ত্রকে Rule of Majority বলেছেন। আবার অনেকেই একমত হয়েছেন এই বলে, জনগণের কল্যাণ সাধনই গণতন্ত্রের মূল কথা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্থপতি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফার্ষণ। তাঁর মতে, গণতন্ত্রের মর্ম হোল স্বাধীনতা। তিনি বলতেন, যে শাসন ব্যবস্থায় নাগরিকদের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি এমনকি সেই সরকার যদি দুর্বলও হয়, তথাপি সেই শাসনব্যবস্থাই সবচেয়ে ভালো। জেফার্ষণ (Jefarson ) বলতেন, মানুষ কতগুলি অবিচ্ছেদ্য অধিকার নিয়ে জন্মায়। এগুলি হোল জীবন, স্বাধীনতা ও সুখানুসন্ধানের অধিকার। গণতন্ত্রই পারে সেই অধিকারগুলি পূরণ করতে। মনে রাখতে হবে, দেশের জনসাধারণ কে তিনি সন্তানের চোখে দেখতেন। এভাবেই তিনি গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হয়ে উঠেছেন। এবার আসি গণতন্ত্র সম্বন্ধে সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন কী বলেছেন। আগেই বলা হয়েছে, গণতন্ত্র নিয়ে রাধাকৃষ্ণনের বক্তব্য প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন বা টমাস জেফারসন যা বলে গিয়েছে তার থেকে কোনও অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ গণতন্ত্র নিয়ে পড়াশোনার সময় আব্রাহাম লিঙ্কন ও টমাস জেফারসন সহ অনেকের মন্তব্য তুলে ধরা হলেও বিশিষ্ট দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও কূটনীতিক রাধাকৃষ্ণনের কথা উল্লেখ করা হয় না। রাধাকৃষ্ণন তাঁর বিখ্যাত বই " Religion and Society " তে গণতন্ত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ' গণতন্ত্রের গতি ' শীর্ষক আলোচনায় শুরুতেই তিনি লিখেছেন, নীতিশাস্ত্রের একটা তত্ত্ব আছে যে মানুষের আসল উদ্দেশ্য দায়িত্বযুক্ত স্বাধীনতা লাভ। গণতন্ত্র সেই নীতিরই রাষ্ট্রনৈতিক রূপ। তিনি বিখ্যাত দার্শনিক কান্টের (kant) বিখ্যাত নীতিবাদ " নিজের মধ্যেই হোক বা অন্যের মধ্যেই হোক মানুষকে কখনও লক্ষ্য সাধনের উপায় বলে মনে করো না, তাকেই লক্ষ্য বলে সবসময় দেখো " সমর্থন করে বলেছেন এটাই গণতান্ত্রিক বিশ্বাসের মূল কথা। তিনি আরও বলেছেন, " গণতন্ত্রের লক্ষ্য হোল সমগ্র সমাজের স্বার্থ রক্ষা করা। কোনও শ্রেণীবিশেষ বা সম্প্রদায়বিশেষের নয়। জাতি ধর্ম বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই শুধু তাঁর মনুষত্বের খাতিরেই রাষ্ট্রনৈতিক সমাজে গ্রহণ করা উচিত। তাঁর মতে, গণতন্ত্র গণশাসন এই অর্থে যে গণ বলতে সমাজের সব লোককেই বোঝায়। সংখ্যালঘিষ্ঠদের উৎপীড়ন ও তাঁদের মতামতকে অগ্রাহ্য করা গণতন্ত্রবিরোধী। তিনি পরিষ্কার বলেছেন," সংখ্যালঘিষ্ঠদের যদি দাবিয়ে রাখা হয়, তাঁদের মতামত প্রকাশ না করতে দেওয়া হয় তো গণতন্ত্র স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়। " তাঁর মৃত্যুর (১৯৭৫) প্রায় ৫০ বছর পর আমাদের দেশের কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দিকে তাকিয়ে আগাম পরিণতি ভেবে লিখেছিলেন কি না জানি না! কিন্তু এটা ঘটছে এখন। সংখ্যালঘুদের কি আদৌ মান্যতা দিচ্ছে দুই সরকার ? গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে কার্যত দুই সরকার স্বেচ্ছাচারী সরকারে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে গ্রিসের পেরিকল্লিস, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসী বিপ্লব ও রুশ বিপ্লবের কথা উল্লেখ করেছেন রাধাকৃষ্ণন। তিনি কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (১৮৪৮)র উল্লেখ করে বলেছেন, " সমষ্টির স্বাধীন বিকাশের শর্ত হবে ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশ। " তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য হোল রাষ্ট্রীয় অধিকার সম্বন্ধে মানুষের অধিকার স্বীকার করা। আর সামাজিক গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য হোল সকল মানুষকে সামাজিক সুবিধাগুলিতে সমান অংশ দেওয়া। " মনে রাখতে হবে রাধাকৃষ্ণন কিন্তু কার্ল মাৰ্ক্সের অনেক নীতিকে সমর্থন করেছেন। তা বলে তিনি মার্ক্সবাদী হয়ে যান নি। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, সমাজের এখনকার সমাজ ব্যবস্থায় সমান সুযোগের দাবির অর্থ, সমস্টিগত উৎপাদনের উপাদানগুলির উপর যে সব মালিকের সমাজের কাছে কোন দায়িত্ব নেই তাঁদের অধিকাংশ লোপ করে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রবর্তন। তিনি কিন্তু মাৰ্ক্সের শ্রেণীহীন সমাজের কথা বিশ্বাস করেন নি। তাঁর মতে, " শ্রেণীহীন সমাজ অবান্তর। " গণতন্ত্র সার্থক হবে কীভাবে ? রাধাকৃষ্ণন বলেছেন, আমাদের গণতন্ত্র যদি সার্থক হয়, তাহলে আমরা এমন সামাজিক বিধানের সৃষ্টি করবো যাতে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক লোকের পেশা ও নিরাপত্তা রক্ষিত হবে, তরুণদের যথাযথ শিক্ষার দ্বারা তাঁদের বিশেষ ক্ষমতা বিকাশের ব্যবস্থা থাকবে, জীবনের পক্ষে শুধু অবশ্য প্রয়োজনীয়ই নয়, আরামদায়ক বস্তুরও বিতরণের ব্যবস্থা থাকবে, আর বেকারীর কষ্ট নিবারণের জন্য পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা ও আত্মবিকাশের স্বাধীনতা থাকবে। রাধাকৃষ্ণন ছিলেন একজন মানবতাবাদী দার্শনিক। তিনি গণতন্ত্রকে সামাজিক ও আর্থিক ব্যাপারে মৌলিক পরিবর্তনের উপায় (means) হিসাবে দেখেছেন। তিনি মনে করতেন, গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব। তিনি বলেছেন, “গণতন্ত্র যদি যথেষ্ট শিক্ষিত হয়, তার যদি সকল ভবিষৎ দৃষ্টি ও নৈতিক সাহস থাকে তো সে হিংসা ছাড়াও সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে পারে। "
এলাকার খবর আমাদের সরাসরি জানাতে ফোন বা WhatsApp করুন 9647180572 নম্বরে। নিচের লিঙ্কে টাচ করে ঘাটাল রিপাবলিক টিভি ডিজিটাল মিডিয়ার WhatasApp গ্রূপে যোগ দিন 👇